শিক্ষায় বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার

শিক্ষায় বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার

বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষার ধারণা দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আর এর মূল কারিগর হচ্ছে প্রযুক্তি। আগে যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু বই, কলম আর বোর্ডের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে এখন তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্ঞানের বিস্তৃত ভাণ্ডারে প্রবেশ করছে। আমার দৃষ্টিতে প্রযুক্তি আজ আর ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং এটি শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সব জায়গাতেই শিক্ষার কার্যকারিতা, নমনীয়তা এবং বিশ্বমান নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

কম্পিউটার শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে তা সত্যিই অসাধারণ। আমি মনে করি কম্পিউটার এখন শিক্ষার্থীদের জন্য একজন বিকল্প শিক্ষক বা সহকারী হিসেবে কাজ করছে। এটি শিক্ষার্থীদের তথ্য অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে এবং সৃজনশীল কাজের সুযোগ করে দেয়। যেমন, জ্যামিতির কঠিন ধারণাগুলো শিক্ষার্থীরা 3D মডেলিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজেই বুঝতে পারে, যা কেবল বই পড়ে বোঝা মুশকিল। Photoshop ও অন্যান্য গ্রাফিক্স সফটওয়্যার শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে কোনো দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চমানের শিক্ষাসামগ্রী ইন্টারনেট থেকে সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী এবং সময় ও ক্ষেত্রগত সীমাবদ্ধতা দূর হচ্ছে। আমি লক্ষ্য করেছি, Coursera, Khan Academy ও edX-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের শিক্ষার বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, যেখানে তারা ঘরে বসেই বিশ্বের সেরা বিষয় শিখতে ও অনুশীলন করতে পারছে। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে শিক্ষার্থীরা দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে শিখতে পারে, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখে ।

অন্যদিকে মোবাইল ফোন শিক্ষাকে আরো সহজ ও সুবিধাজনক করেছে। আমি একে “পকেট শিক্ষালয়” বলি, কারণ এটি যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গা থেকে শিক্ষার নতুন দরজা খুলে দেয়। বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের মাধ্যমে Google Classroom ব্যবহার করে, যেখানে তারা সহজেই শিক্ষক এবং বন্ধুদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। হোমওয়ার্ক জমা দেওয়া, শিক্ষকের মতামত পাওয়া বা গ্রুপ আলোচনায় অংশ নেওয়া—all কিছু এখন এক মোবাইল ফোনেই সম্ভব। Khan Academy-এর মতো শিক্ষামূলক অ্যাপ ভিডিও লেকচারের মাধ্যমে কঠিন বিষয় গুলো বুঝতে সহজ করে তোলে। Duolingo ও Quizizz এর মতো অ্যাপগুলো শেখাকে আরও মজার ও আনন্দদায়ক করে তুলেছে।

তবে মোবাইল ফোন শরীরের খুব কাছে, বিশেষ করে পকেটে রাখলে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব থাকতে পারে, যেমন বিকিরণ বা তাপের কারণে সমস্যা হতে পারে। তাই মোবাইল ব্যবহার করার সময় যতটা সম্ভব নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত এবং শরীর থেকে কিছুটা দূরে রাখা ভালো। এমনটা করলে শিক্ষাও হবে আর শরীরও থাকবে সুস্থ।

শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমার মতে, এটি সবচেয়ে প্রাণবন্ত শিক্ষণ পদ্ধতি। ধরুন, একজন শিক্ষক যদি ভূগোল পড়ানোর সময় শুধু মানচিত্র দেখান, তাহলে শিক্ষার্থীদের বোঝার পরিধি অনেকটা সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু যদি সেই একই বিষয় তিনি ভিডিও বা অ্যানিমেশন দেখান, তাহলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে অনেক বেশি বাস্তবতায় অনুভব করতে পারে। মাল্টিমিডিয়ার সাহায্যে অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা শিক্ষার্থীদের শুধু তথ্য শেখায় না, বরং সেটি তাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। যেমন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়টি বই থেকেই বোঝানো কঠিন, কিন্তু ইনফোগ্রাফিকস বা ডকুমেন্টারি দেখালে তা দ্রুত স্পষ্ট হয় এবং সহজে মেমোরিতে জমে থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং শেখার প্রতি আগ্রহও বৃদ্ধি পায়। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করলে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশও হয় আরও প্রাণবন্ত, যা শেখার প্রক্রিয়াকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে।

সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন অনেক জায়গায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করা হচ্ছে। এই ক্লাসরুমগুলোতে ছবি, ভিডিও, অ্যানিমেশন ও গ্রাফিক্সের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়, যা শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় অনেক সুবিধা দেয়। শিক্ষকরা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কঠিন ও জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে বোঝাতে পারছেন এবং শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছেন। ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। মাল্টিমিডিয়ার কারণে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বেশি আধুনিক ও ফলপ্রসূ হয়েছে।

ই-লার্নিং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই বদলে দিয়েছে। আমার অভিজ্ঞতায়, ই-লার্নিং শিক্ষার্থীদের জন্য এমন এক ধরনের স্বাধীনতা নিয়ে আসে যা আগে কখনো সম্ভব ছিল না। এখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুবিধামতো যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে বিশ্বের সেরা কোর্সগুলো করতে পারে। তারা তাদের গতিতে লেকচার শুনতে পারে, অনলাইনে পরীক্ষা দিতে পারে, এবং বিভিন্ন ডিজিটাল টুল যেমন ভিডিও লেকচার, পডকাস্ট, অনলাইন কুইজ ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে শিখতে পারে। শিক্ষকরা আর শুধু ক্লাসরুম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেন না, তারা অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন ঘরে বসেই জাপান, আমেরিকা, কিংবা ইউরোপের নামকরা শিক্ষকের ক্লাসে অংশ নিতে পারছে। Zoom, Google Meet এর মতো প্ল্যাটফর্ম এসব ক্লাসের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয়। ফলে শিখন প্রক্রিয়া অনেক বেশি সহজ, দ্রুত এবং কার্যকরী হয়ে উঠেছে। এই আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু যে শিক্ষা পাচ্ছে তা নয়, বরং তাদের সময় ও খরচও অনেকটা সাশ্রয় হচ্ছে। ই-লার্নিং শিক্ষার ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করেছে এবং আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিচ্ছে ।

প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য ইন্টারঅ্যাকটিভ টুলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Quizizz, Kahoot-এর মতো কুইজ টুলগুলো ক্লাসরুমের পরিবেশকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখতে গিয়ে অনেক মজা পায় এবং তাদের পড়ার আগ্রহও অনেক বেড়ে যায়। আমি লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের অনেক আধুনিক স্কুলই এই ধরনের ইন্টারঅ্যাকটিভ মাধ্যম ব্যবহার করছে, যার ফলে শিক্ষার মান আরও উন্নত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা Google Earth বা Geogebra এর মতো টুল ব্যবহার করে ভূগোল বা গণিতের জটিল বিষয়গুলো সহজে, চোখের সামনে বাস্তব আকারে বুঝতে পারছে। এই ধরনের ভিজ্যুয়ালাইজেশন শিক্ষাকে করে তোলে আরও উপভোগ্য ও কার্যকরী। আবার, Skype বা Zoom এর মাধ্যমে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে এবং মতবিনিময় করতে পারছে। এতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ থেকে মুক্তি পেয়ে বৈশ্বিক মাত্রায় বিস্তৃত হচ্ছে।

এই ইন্টারঅ্যাকটিভ টুলগুলো শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়ায়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে শেখার প্রক্রিয়াকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ করে তোলে। এক কথায়, এগুলো আধুনিক শিক্ষার পরিবেশকে সাজানোর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় আগ্রহকেও দ্বিগুণ করে ।

আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি বড় সুযোগ হলো ডিজিটাল রিসোর্সের ব্যবহার। একসময় অতিরিক্ত বই বা লেকচার নোট সংগ্রহ করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা Google Books, অনলাইন লাইব্রেরি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল রিসোর্স থেকে যে কোনো বই বা উপকরণ সংগ্রহ করতে পারছে। তারা চাইলে PDF আকারে বই পড়ে কিংবা ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে একই বিষয় পুনরাবৃত্তি করতে পারে। এর মাধ্যমে শেখা হয়েছে আরও সাশ্রয়ী, দ্রুত এবং সহজলভ্য।

ফলস্বরূপ, আমি মনে করি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর প্রভাব শুধু শিক্ষার্থীর শেখার প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি শিক্ষকদের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেমন জ্ঞানের বিস্তৃত ভাণ্ডারে প্রবেশ করছে, তেমনি শিক্ষকরা ক্লাসকে আরও সৃজনশীল ও কার্যকর করে তুলতে পারছেন। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এটি এক বড় আশীর্বাদ, কারণ সামান্য সম্পদ দিয়েই বিশ্বমানে শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে।

সবশেষে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর। আজ যা আমরা পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করছি, আগামী দিনে এটি হবে শিক্ষার আসল ভিত্তি। কম্পিউটার, মোবাইল, মাল্টিমিডিয়া ও ই-লার্নিং মিলেই গড়ে উঠবে একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, যা শুধু পরীক্ষার খাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সামর্থ্য দেবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যদি এই প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারে, তবে তাদের সামনে যে উন্নত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তা আর কেবল কল্পনা নয়, বরং এক বাস্তব সম্ভাবনা।