বুলিং বা নিগ্রহ: একটি সামাজিক ও মানসিক সমস্যা

বুলিং বা নিগ্রহ: একটি সামাজিক ও মানসিক সমস্যা

আজকের দিনে বুলিং বা নিগ্রহ একটি খুবই সাধারণ, কিন্তু ক্ষতিকর সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিশ্বব্যাপী এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, কাজের জায়গা থেকে শুরু করে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবেশে বুলিং দেখা যায়। বাচ্চাদের থেকে বড়দের মধ্যেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। বুলিং মানসিক, শারীরিক কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমেও হতে পারে, যার প্রত্যেক রূপই ভুক্তভোগীদের জীবনে গভীর ক্ষতি করে।

বুলিং বলতে বোঝায় কারো প্রতি শারীরিক বা মানসিকভাবে বারবার হওয়া অন্যায় আচরণ যা তাকে আঘাত করে। এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

প্রথমত, শারীরিক বুলিং হয় যখন কেউ কাউকে ধাক্কা দেয়, লাথি মারে, মারধর করে বা কোনো ধরণের দৈহিক নির্যাতন করে। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলে যখন কোনো বড় ছেলেরা ছোট ছেলেদের পেটায় বা ঠেলে দেয়, তখন সেটি শারীরিক বুলিং বলে।

দ্বিতীয়ত, মৌখিক বুলিং হলো গালাগালি করা, অবজ্ঞাসূচক কথা বলা বা কাউকে অপমান করা। যেমন কেউ কাউকে নাম দিয়ে ডাকায় বা তাকে ছোট করে বলে, তা মৌখিক বুলিং।

তৃতীয়ত, সামাজিক বুলিং সেই আচরণ যেটার মাধ্যমে কাউকে গ্রুপ থেকে বাদ দেয়া হয়, গুজব ছড়ানো হয় কিংবা সামাজিকভাবে একা-একা ফেলে দেওয়া হয়। যেমন কোনো শিশু বা ব্যক্তিকে বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের থেকে purposely বাদ দেওয়া বা চুপ করে থাকা।

আরেকটি আধুনিক রূপ হলো সাইবার বুলিং, যা ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে ঘটে। এতে মোবাইলে অপমানজনক বার্তা পাঠানো, হুমকি দেওয়া বা ছবির মাধ্যমে কাউকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা অন্তর্ভুক্ত। সাইবার বুলিং বেভূতি বাড়ছে কারণ আক্রমণকারীরা প্রায়শই নিজেদের পরিচয় গোপন রাখে এবং অত্যন্ত সহজেই কাউকে ক্ষতি করতে পারে।

সাধারণত, বুলিং ঘটে তখন যখন আক্রমণকারীর কাছে বেশি ক্ষমতা থাকে, আর ভুক্তভোগী অনেকে সময় সেই সমঝোতার বাইরে বা দুর্বল অবস্থায় থাকে। তাই বুলিং একটি ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার ফল। এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত নানা মাত্রায় ঘটতে পারে এবং ব্যক্তির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

বুলিং কেন হয়? এর পেছনে অনেক জটিল কারণ কাজ করে, যার মধ্যে ব্যক্তিগত ও মানসিক দুর্বলতার গুরুত্ব অসীম। অনেক সময় যাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা থাকে, তারা সহজেই রেগে গিয়ে অন্যদের ক্ষতি করে। যেমন, রেগে গিয়ে বাচ্চারা অনেক সময় অন্য শিশুদের ঠেলে দেয়, গালাগালি করে বা মানসিক অবজ্ঞা করে। এই ধরনের আচরণ তাদের ক্রোধ এবং হতাশা থেকে উদ্ভূত হয়।

অন্যদিকে, অনেক শিশু নিজের অদৃশ্য দুর্বলতা ঢাকতে বা বড় দেখানোর জন্য বুলিংয়ের আশ্রয় নেয়। তারা মনে করে অন্যদের ডরিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তারা নিজেদের অবস্থা ভালো করতে পারবে। এটি অনেক সময় আত্মসম্মান কম থাকার প্রতিফলন।

পরিবারে সহিংসতা বা কঠোর পরিবেশ থাকলেও সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেখানে বাবা-মায়ের তিক্ততা বেশি বা ভালো নজরদারি কম, সেখানে শিশু মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে। সেটা তার আচরণে প্রকাশ পায়, যেমন খুব রেগে যাওয়া, বাধ্য হয়ে অন্যদের অবমাননা করা। যেসব পরিবারে শিশুদের ভালোবাসা কম দেয়া হয় বা তাদের কথা শোনা হয় না, তাদের মধ্যে বুলিং প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

বন্ধুদের প্রভাবও অনেক বড়। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটালে সেই নেতিবাচক আচরণ সহজেই গৃহীত হয়। মিডিয়া ও ইন্টারনেটের প্রভাবও বড়—সহিংস ভিডিও, গেম বা অনলাইনে বাজে কথার কারণে অনেক শিশু হিংস্র হয়ে ওঠে, যা তাদের আচরণে ঝলকে।

স্কুলে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকলে বা কঠোর নিয়ম না থাকলে বুলিং বাড়ে। স্কুলে নিয়ম-নীতি থাকলেও তা সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে বুলিরা আরও বেশি সক্রিয় হয়। এছাড়া পড়াশোনা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম-বর্ণ, সংস্কৃতির ভিন্নতা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে, যা বুলিংয়ের কারণ হয়।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে সাইবার বুলিং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অনলাইনে পরিচয় লুকিয়ে অপমান, গুজব ছড়ানো খুব সহজ হয়েছে। এর প্রভাব অনেক গুণ বেশি দীর্ঘমেয়াদি ও মানসিক।

সমগ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গেলে, বুলিং একক কোনো কারণ নয়, বরং ব্যক্তিগত মানসিক দুর্বলতা থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও ডিজিটাল প্রভাবের মিশ্রণ। এই সব কারণ একসঙ্গে কাজ করে বুলিংয়ের জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে।

বুলিংয়ের প্রভাব সত্যিই ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যারা এই নিগ্রহ বা নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের আত্মসম্মানে মারাত্মক আঘাত লাগে। তাদের মনে হয় তারা কম যোগ্য, কম গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ কেউ। এর ফলে তারা বিষণ্নতা ও উদ্বেগে ভোগে এবং তাদের ভাবনায় এক ধরনের অন্ধকার ঘিরে ধরা দেয়।

বুলিংয়ের শিকাররা প্রায়ই ঘুমের সমস্যায় পতিত হয়, রাতে ভালভাবে ঘুমাতে পারে না বা বারংবার গভীর চিন্তা তাদের ঘুম ভেঙে দেয়। এর কারণে তাদের শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

শিক্ষার প্রতি তাদের মনোযোগ কমে যায়, তারা ক্লাসবন্দি হয়ে পড়ে অথবা স্কুল বা কলেজে অনুপস্থিতি বাড়ে। এই অনুপস্থিতির ফলে তাদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

সামাজিকভাবে তারা একাকী এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে সরে যায়, কিছু সময় পরিবারের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল, ক্রমাগত বুলিংয়ের শিকার হলে কেউ কেউ স্বল্প চেতনার অবস্থা বা আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। তাই বুলিংয়ের প্রভাবকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না; এটি তীব্রতা ও গভীরতায় জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

সুতরাং, বুলিং প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বুলিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট তথ্য প্রদান করা জরুরি। তাদের বুঝতে হবে যে বুলিং শুধুমাত্র একটি ছোটখাটো সমস্যা নয়, বরং এটা শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

স্কুলগুলোতে স্পষ্ট ও কঠোর বুলিং-বিরোধী নীতি তৈরি করা ও তা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে বুলিংয়ের ঘটনা দ্রুত সনাক্ত করা যাবে এবং তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত, যাতে তারা বুঝতে পারেন কীভাবে বাচ্চাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখানো এবং সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সহায়তা করা যায়। এছাড়াও, সামাজিক স্কিল যেমন বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা, সংঘাত নিষ্পত্তি এবং শ্রদ্ধাশীল আচরণ শেখানো জরুরি, যা বাচ্চাদের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

মূলত, একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন যাতে শিশুরা নিরাপদ এবং সুখী পরিবেশে বড় হতে পারে এবং বুলিংয়ের মতো সামাজিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকে।

পরিবারের ভূমিকা বুলিং প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ঘরোয়া পরিবেশ যেখানে সহিংসতা কম থাকে এবং যেখানে সতর্কতা ও ভালোবাসা প্রবাহিত হয়, সেই পরিবেশ শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হয় এবং বুলিংয়ের ঝুঁকি কমায়। বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিত নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ এবং সন্তানদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রদর্শন করা।

সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের ছোটখাট কথাও গুরুত্ব দিয়ে শোনা খুব প্রয়োজন। এতে শিশুরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে এবং সমস্যা প্রকাশে আগ্রহী হয়। বাবা-মারা যত বেশি সময় দেবেন, তত শিশুরা মানসিক ভাবে সজাগ ও স্বাবলম্বী হবে।

ডিজিটাল যুগে যখন সাইবার বুলিং বা অনলাইন নিগ্রহ বেড়েই চলেছে, তখন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবক বা পরিবারকেই বাড়িতে ভালো ডিজিটাল ব্যবহার শেখানো এবং অনলাইনের ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন করতে হবে, যাতে সন্তানরা সুরক্ষিত থাকতে পারে।

সুতরাং, পরিবারকে একটি সান্ত্বনাময়, সুরক্ষিত এবং সহায়ক জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শিশু মানসিক ও সামাজিকভাবে নিজেকে শক্তিশালী করে উঠতে পারে।

 

বুলিং একটি একাত্ত্বিক ব্যক্তি নয়, এটি সমাজের সমস্যা। সম্মিলিত সচেতনতা ও সম্মান শেখানোর মাধ্যমে আমরা বুলিং প্রতিরোধ করব এবং একটি সুস্থ, নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব।