কেন কম বয়সেই পুরুষরা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে ?

কেন কম বয়সেই পুরুষরা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে  ?

আজকের সমাজে একটি আতঙ্কজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে—কম বয়সী পুরুষদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগে মৃত্যুর হার দ্রুত বেড়ে চলছে। একজন মনোবিজ্ঞান গবেষক হিসেবে আমি এই বিষয়টিকে কেবল শারীরিক সমস্যা হিসেবে দেখি না, বরং এটি একটি জটিল মনোসামাজিক সংকট বলেও মনে করি। এই সংকটের পেছনে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ, সামাজিক প্রত্যাশা, পারিবারিক ও আর্থিক চাপ, করোনার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব, এবং দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি।

 

মানসিক চাপ ও হরমোনের প্রভাব

দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস বা মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসল নামক হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। কর্টিসল বাড়ার ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, ইনসুলিন প্রতিরোধ বৃদ্ধি পায় ও ধমনিতে চর্বি জমে, যেগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। একই সময়ে, মানসিক চাপের কারণে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায়, যা পুরুষদের শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে তোলে। এই ভারসাম্যহীনতা শরীর এবং মনের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে ।​

সামাজিক ও পারিবারিক চাপ

পুরুষদের ওপর সমাজ এখনও এক ধরনের প্রচলিত প্রত্যাশা রাখে, যেখানে তারা ‘উপার্জনকারী’ এবং ‘পরিবারের স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচিত হন। তাই পারিবারিক দায়িত্ব, দাম্পত্য সমস্যা, আর্থিক অনিশ্চয়তা এসব মিলিয়ে তারা এক বিরাট মানসিক বোঝা বহন করে চলেন। এই সামাজিক প্রত্যাশা অনেক সময় পুরুষদের ‘ভিতরে রাখা মানসিক যন্ত্রণা’ হিসেবে প্রকাশ পায়, যা অতিরিক্ত স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক অশান্তি ও আর্থিক উদ্বেগ যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ৩০% বেশি হয়ে থাকে ।​

করোনা মহামারির শারীরিক ও মানসিক প্রভাব

করোনা ভাইরাসের শারীরিক প্রভাব হৃদরোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। করোনা সংক্রমণের পর ‘লং কভিড’ নামে পরিচিত দীর্ঘস্থায়ী নানা উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন ফুসফুসের দুর্বলতা, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া ও প্রদাহজনিত সমস্যা, যা হৃদযন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শরীরের এই দুর্বলতা মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। করোনা মহামারির সময় অনেক পুরুষ একাকিত্ব, উদ্বেগ, ও শোকে ভুগেছে, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে বর্বরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঘুমের সমস্যা এবং ধূমপানের অভ্যাস এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ।​

দাম্পত্য সম্পর্ক, বিশ্বাস ও সামাজিক উদ্বেগ

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের সহমর্মিতা এবং বিশ্বাস বাইরে থেকে যতটা ছোট মনে হতে পারে, মনোবিগ্রহ ও মানসিক স্বাস্থ্যে এর গভীর প্রভাব পড়ে। দাম্পত্য জীবনে মনোমালিন্য, অবিশ্বাস বা যোগাযোগের অভাব মানসিক চাপকে বাড়িয়ে দেয় এবং একাকিত্ব বা সামাজিক উদ্বেগের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের অনেক পুরুষ সমাজের প্রচলিত ধারণার কারণে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করা থেকে ভয় পান, যা মানসিক সাহায্য পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই গোপন মানসিক যন্ত্রণা আত্মঘাতী প্রবণতা, মাদকাসক্তি এবং হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় ।​

সামাজিক মনোবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট

সামাজিক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব দ্বারা পরিচালিত হয়। পুরুষদের এক ধরণের সামাজিক প্রত্যাশা থাকে, যার কারণে তারা মানসিক চাপের কথা প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় এই চাপ তারা নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখেন এবং প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা না নেয়ায় তা শরীর ও মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সামাজিক উদ্বেগ ও একাকিত্ব হৃদরোগের ঝুঁকি নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।​

কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য কারণ

হার্ট অ্যাটাক কম বয়সে বাড়ার পেছনে রয়েছে ধূমপান, মাদকাসক্তি, স্থূলতা, অলস জীবনযাপন, অনিদ্রা এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। এগুলো শরীরের রক্তনালিতে চর্বি জমার প্রবণতা বৃদ্ধি করে এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া জিনগত কারণও গুরুত্বপূর্ণ, পরিবারের মধ্যে হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায় ।​​

 

নিচের টেবিলটি পুরুষদের কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার প্রধান কারণগুলো এবং প্রতিটির আনুমানিক শতকরা ভাগ দেখায়:

কারণ

শতকরা ভাগ (%)

দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ও কর্টিসল বৃদ্ধি

৩০

টেস্টোস্টেরন হ্রাস

১৫

পারিবারিক ও আর্থিক চাপ

২০

করোনা মহামারির শারীরিক প্রভাব

১০

দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি ও বিশ্বাসের অভাব

১০

সামাজিক উদ্বেগ ও একাকিত্ব

১০

ধূমপান ও অবসাদ

প্রতিরোধের উপায়

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের জন্য সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্তরে কাজ করা প্রয়োজন। নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা, মানসিক সাহায্যের জন্য কাউন্সেলিং গ্রহণ, আর্থিক পরিকল্পনা এবং সামাজিক সংযোগ রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। একাকিত্ব দূর করে সামাজিক জীবনে সক্রিয় থাকা হৃদরোগ ও মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি কমায় ।​

 

উপসংহার

আজকের পুরুষরা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও সামাজিক চাপেও ভুগছেন। কর্টিসল ও টেস্টোস্টেরনের ভারসাম্যহীনতা, করোনার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব, পারিবারিক ও আর্থিক চাপ একযোগে একটি বরঞ্চ নিঃশব্দ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। হার্ট অ্যাটাক তাই কেবল হৃদয়ের রোগ নয়, এটি সমাজ, মন এবং জীবনের এক সম্মিলিত সংকেত। এই সংকেতে সাড়া দিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।

 

রেফারেন্স (References)

  1. Medicover Hospitals. “High Cortisol Levels: Causes and Management.” (2025).​
  2. Circulation Journal. “Cortisol, Testosterone and Coronary Heart Disease.” (2005).​
  3. Continental Hospitals. “Stress and Mental Health in Men.” (2025).​
  4. Daily Janakantha. “How Stress Affects Men’s Sleep and Heart.” (2025).​
  5. BetterHelp. “Men & Money: Facing the Pressure to Provide.” (2025).​
  6. ScienceDirect. “Cardiovascular Consequences of Financial Stress.” (2023).​
  7. NY.Gov. “Mental Health in Post-COVID Era.” (2025).​
  8. Nature. “Loneliness and Negative Thinking Related to Heart Disease.” (2025).​
  9. Wikipedia & Wikiwand. “Social Psychology: Study of Behavior in Society.” (2020).​
  10. Prothom Alo. “অল্প বয়সেও কেন হার্ট অ্যাটাক হয়.” (2025).​
  11. Drobal Health Bangladesh. “অল্প বয়সেই হার্ট অ্যাটাক কী কারণ?” (2023).​
  12. Kaler Kantho. “কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কেন বাড়ছে?” (2025).​